নষ্ট হচ্ছে এলিফেন্টা কেভ, হারাচ্ছে ইতিহাস

the precious elephanta caves is on verge of extinction and needs immediate attention

গৌতমী সেনগুপ্ত

মাঝ সমুদ্রে ছোট্ট ভেসেল, ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে যাচ্ছে বেশ। মনের ভিতর এক অজানা উত্তেজনা,  এক দিনের মুম্বই সফরে সময় বার করে এলিফেন্টা কেভের পথে আমি। কম পাওয়া নাকি। কিন্তু পৌঁছে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ইতিহাস আসলে  ধ্বংসেরই অপেক্ষায়।
প্রধানত দুটি, এছাড়াও ছোট-বড় আরও অনেক গুহার স্থাপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে খ্রীষ্টপূ্র্ব পাঁচ- ছয় শতাব্দীর প্রাচীণ এলিফেন্টা কেভ। যার বেশিরভাগটাই এখন ভেঙে পড়েছে।  অস্তিত্বের লড়াইয়ে  ধুকছে। হেরিটেজ ঘোষিত এলিফেন্টা আজ  আরকিওলজিক্যাল সার্ভে  অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানেও দৈন দশায়। খামতিটা তাহলে ঠিক কোথায়, খোঁজ করতেই বেশ তোতলাতে শুরু করলেন সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।
উঁচু-নীচু পাথুরে পথ  পেরিয়ে যখন ইতিহাসকে অসম্মানিত হতে দেখি, খারাপ লাগার পরিধিটা হঠাৎ বেড়ে যায় । এলিফেন্টা কেভের মূল আকর্ষণ শিবের তিন মুখ। যার একটা পাশ ক্ষয়ে গিয়েছে। স্থাপত্যটিকে ধরে রাখার পিলারগুলিও ক্রমশ ভাঙছে। উপরে তাকালে দেখা যাবে  গুহার ক্ষত-বিক্ষত  সিলিং।



কেন এই ভগ্ন দশা..
নিরাপত্তায় থাকা কর্মীরা বলেই ফেললেন, যে হারে টাকা নয়ছয় হচ্ছে তাতে সংস্কার করার তো দূরের কথা, নজরদারিতেও গাফিলতি থেকে যাচ্ছে।
এলিফেন্টা কেভের এনট্রি ফি ভারতীয়দের ক্ষেত্রে মাথা পিছু ৪০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে ৬০০ টাকা। এনট্রি ফি থেকে সংগৃহীত টাকাই গুহা সংস্কারের কাজেই লাগানো হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আরকিওলজিক্যাল সার্ভে  অফ ইন্ডিয়া। কিন্তু, সেই টাকাই এখন নয়ছয় হচ্ছে বলে খবর। যার বড়সড় খেসারত দিতে হচ্ছে এলিফেন্টা কেভকে। সংস্কারের অভাবে ধুকছে এলিফেন্টার দ্বিতীয় গুহা। যেখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির অর্ধেক অংশ ভাঙা। প্রথম গুহার নৃত্যরত দেবী দুর্গার মূর্তিরও একই অবস্থা। ভেঙে গিয়েছে হাত। মাথার মুকুট।


প্রথম গুহা থেকে নীচে নামতেই দেখা মিলল মুক্ত প্রাঙ্গনের। শোনা যায় ১৯৬০ সাল থেকেই এই প্রাঙ্গন ভাঙতে শুরু করে। সংস্কারের অভাবে সেই ভাঙা প্রাঙ্গন এখন আরও বিপজ্জনক। বেরিয়ে গিয়েছে হাড়-গোড়।তাই প্রায় হোঁচট খেতে খেতেই পরবর্তী প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের দিকে এগোলাম।
 পাহাড়, জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। পাথর খোদাই করে তৈরি নিখুঁত স্থাপত্য। খ্রীষ্ট পূর্ব পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যেই ৫-৬টি ছোট বড় গুহা নিয়ে তৈরি হয়েছিল  এলিফেন্টা কেভ। কখনও মৌর্য, কখনও বা রাষ্ট্রকূট, চালুক্য রাজ বংশের তত্ত্বাবানে বেড়েছে গুহার স্থাপত্য-ভাস্কর্য্য। ১৫৯০-৯৪ সালের মধ্যে প্রথম পর্তুগীজরা সমুদ্রের মাঝে থাকা এই ঐতিহাসিক রহস্যকে সামনে আনে। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশরা সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। তবে ১৯৬০ সাল থেকেই ভাঙছে এই গুহা।  ১৯৮৭ সালে মেলে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা। এই সবকিছুই শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম ১৯৮৭ থেকে ২০১৯, এই দীর্ঘ সময়ে এলিফেন্টা কেভের সংস্কারের জন্য ঠিক কী কী করা হয়েছে?




কিছু হয়েছে তো বটেই..

মুম্বই থেকে ১০ কিমি সমুদ্রপথ পেরিয়ে ঐতিহাসিক কেভ। ভেসেলের টিকিটের দাম বেশ চড়া । গুহায় যেতে গেলে পেরোতে হবে অনেকটা পথ । সেই পথ জুড়ে রকমারি পসরা সাজিয়ে বসেছেন স্থানীয়রা। প্রাচীন গুহার সিঁড়ির দুই পাশ সেজেছে, গয়না-গাটি, নকল অ্যান্টিকের বাহারি দোকানে। তারপরই টিকিট কাউন্টার। ৪০ টাকায় গুহা দর্শন।
দায়সারা ভাবে ঘুরলে বেশ উপভোগ্য সফর। কিন্তু, ইতিহাসকে ভালোবাসলে কষ্টটা মনের গভীরে চেপে থাকে। বাধ্য হয়েই মনের কষ্ট প্রশ্নের আকারে বেরিয়েও আসে। তাই কর্মীদের জিজ্ঞেসই করে ফেললাম ,  ‘টাকাগুলো কোথায় যায়’
মুখে হাল্কা হাসি মাখিয়ে তাঁর উত্তর, ‘দিদি দেখিয়ে, ঘুমিয়ে, ইতনা মত পুছিয়ে’ বুঝলাম এলিফেন্টা কেভের মাথায় বিষন্নতার কালো মেঘ গভীরতর হতে চলেছে ইতিহাসের হাত ধরে। ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এক কাপ কফিতে আমি শুধুই আমাকে চাই...